background

কেন কিছু আফ্রিকান দেশে পেট ক্যান্সার বেশি সাধারণ

post image

পাকস্থলীর ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ যা সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। তবে, এর প্রাদুর্ভাব অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। আফ্রিকার কিছু দেশে এই রোগের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যা এই অঞ্চলের নির্দিষ্ট ঝুঁকির কারণগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন তোলে। খাদ্যাভ্যাস, সংক্রমণ, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবেশগত কারণ এবং জেনেটিক্সসহ বিভিন্ন বিষয় এই রোগের উচ্চ হারের জন্য দায়ী।

হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ

হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ পাকস্থলীর ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান ঝুঁকির কারণ। এই ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীর আস্তরণকে সংক্রমিত করে এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। আফ্রিকায় নিম্নমানের জীবনযাত্রা এবং নিরাপদ পানির অভাবের কারণে এই ব্যাকটেরিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার অভাব রয়েছে, সেখানে সংক্রমণের হার বিশেষভাবে বেশি। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকার কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৭০% এরও বেশি মানুষ H. pylori দ্বারা সংক্রমিত।

এছাড়াও, নিয়মিত স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের অনুপস্থিতি সংক্রমিত ব্যক্তিদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে। তবে, অ্যান্টিবায়োটিক এবং প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর একসঙ্গে ব্যবহারের মাধ্যমে এই সংক্রমণ নিরাময় করা সম্ভব এবং এর ফলে পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

খাদ্যাভ্যাস এবং লবণের উচ্চ গ্রহণ

খাদ্যাভ্যাস পাকস্থলীর ক্যান্সারের হার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আফ্রিকার কিছু জনগোষ্ঠী অতিরিক্ত লবণযুক্ত, গাঁজানো বা ধূমায়িত খাবার গ্রহণ করে, যা পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। অতিরিক্ত লবণ পাকস্থলীর আস্তরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, ফলমূল ও শাকসবজির অপর্যাপ্ত গ্রহণের ফলে শরীরে পর্যাপ্ত অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের অভাব হয়, যা ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়।

আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে রেফ্রিজারেশন সুবিধার অভাবে খাবার সংরক্ষণের জন্য এখনো লবণ এবং ধোঁয়ায় সংরক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। তবে, এই পদ্ধতিগুলি নাইট্রেট যৌগের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা পাকস্থলীতে প্রবেশ করলে কার্সিনোজেনিক পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও, পুড়িয়ে বা গ্রিল করা মাংস নিয়মিত খাওয়ার ফলে পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন নামক ক্যান্সার সৃষ্টিকারী যৌগ শরীরে প্রবেশ করে।

সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভাব

যেসব আফ্রিকান দেশে পাকস্থলীর ক্যান্সারের হার বেশি, সেসব দেশে সাধারণত আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, বিলম্বিত রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধমূলক কর্মসূচির অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। বেশিরভাগ রোগী ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান, যার ফলে চিকিৎসা কম কার্যকর হয়। এছাড়াও, গ্যাস্ট্রোস্কোপির মতো প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলোর সহজলভ্যতা কম থাকায় রোগ নিরাময়ের জন্য বিলম্ব ঘটে।

কিছু অঞ্চলে কম আয় হওয়ায় মানুষ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে পারে না। ফলে, তারা মূলত স্টার্চসমৃদ্ধ খাবার ও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পাশাপাশি, পানি দূষণ এবং কৃষি ও খনন শিল্পের কারণে বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শ পাকস্থলীর ক্যান্সারের হার বাড়িয়ে তোলে।

জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণ

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কিছু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী জেনেটিক কারণে পাকস্থলীর ক্যান্সারের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। আফ্রিকায় এই জেনেটিক প্রবণতা পরিবেশগত বিষক্রিয়া দ্বারা আরও তীব্র হতে পারে, বিশেষ করে যখন বিষাক্ত পদার্থে দূষিত পানি ও কীটনাশক-দূষিত মাটি মানুষের সংস্পর্শে আসে।

গ্রামাঞ্চলে কাঠ ও কয়লা ব্যবহার করে রান্নার ফলে বায়ুদূষণ হয়, যা মানুষকে সূক্ষ্ম কণার সংস্পর্শে আনে। এই কণাগুলি শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়।

প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ

আফ্রিকায় পাকস্থলীর ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতা এবং স্যানিটেশনের উন্নতি H. pylori সংক্রমণের হার কমাবে। পাশাপাশি, খাদ্যাভ্যাস উন্নত করার জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে বেশি ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া উচিত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া সীমিত করা উচিত।

স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামোর উন্নতি করা জরুরি। গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পারিবারিক ক্যান্সার ইতিহাস থাকা রোগীদের জন্য প্রাথমিক স্ক্রিনিং সুবিধা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হলে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

চিকিৎসার দিক থেকে, আফ্রিকায় এখনও যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা নেই। শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে অস্ত্রোপচার সহজলভ্য, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তা পাওয়া কঠিন। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপিও অনেকের জন্য ব্যয়বহুল এবং সহজলভ্য নয়। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি, যেমন টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি, খুব সীমিত পর্যায়ে পাওয়া যায়।

চিকিৎসা পেশাদারদের প্রশিক্ষণ আরও উন্নত করা হলে প্রাথমিক লক্ষণ চিহ্নিত করা সহজ হবে এবং রোগীদের দ্রুত সঠিক চিকিৎসার জন্য পাঠানো সম্ভব হবে। সরকার, এনজিও এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন, যাতে রোগীদের ভালোভাবে সহায়তা করা যায় এবং কার্যকর জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা যায়।

উপসংহার

আফ্রিকার কিছু দেশে পাকস্থলীর ক্যান্সারের উচ্চ হার অনেকগুলো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণের ফলে ঘটে, যেমন H. pylori সংক্রমণ, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পরিবেশগত কারণ। বিস্তৃত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা প্রচারাভিযান রোগের হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

Whatsapp Us