background

ধূমপায়ী এবং অধূমপায়ী: কেন কেউই ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে নিরাপদ নয়?

post image

ফুসফুসের ক্যানসার একটি ভয়ঙ্কর রোগ যা প্রতি বছর সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘদিন ধরে এটি ধূমপায়ীদের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, এখন এটি ধূমপায়ী ও অধূমপায়ীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। কারণ এটি এখন জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করছে। যদিও ধূমপান এখনও প্রধান ঝুঁকির কারণ, অন্যান্য কারণও এই রোগের উদ্ভবের জন্য দায়ী হতে পারে। এ কারণে প্রশ্ন ওঠে: আসলে কারা ফুসফুসের ক্যানসার থেকে সুরক্ষিত? বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে যে যারা কখনো ধূমপান করেননি, তারাও এই ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন।

ধূমপানের প্রভাব ফুসফুসের ক্যানসারে

ধূমপান ফুসফুসের ক্যানসারের প্রধান কারণ। অনুমান করা হয় যে, প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ফুসফুসের ক্যানসারের ঘটনা সরাসরি তামাক গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত। সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা কার্সিনোজেনিক পদার্থ, যেমন টার ও নাইট্রোসামিন, ফুসফুসের কোষে ক্ষত সৃষ্টি করে যা ম্যালিগন্যান্ট টিউমার গঠনের দিকে পরিচালিত করতে পারে। ধূমপানের সময়কাল ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে ঝুঁকি বাড়ে। এজন্য ধূমপানকে ধূমপায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে ধরা হয়।

ধূমপানের মাধ্যমে যে রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসে প্রবেশ করে, তা ক্রমাগতভাবে ফুসফুসের কোষগুলোর ডিএনএ পরিবর্তন করতে পারে। ফলে, কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে এবং টিউমার গঠিত হয়। এছাড়াও, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুস সংক্রমণ বা শিল্প দূষণকারী পদার্থের সংস্পর্শ এ ধরণের ক্ষতির জন্য দায়ী হতে পারে।

অধূমপায়ীরা কেন আক্রান্ত হন?

যদিও ধূমপান ফুসফুসের ক্যানসারের প্রধান কারণ, অধূমপায়ীরাও ঝুঁকিমুক্ত নন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ফুসফুসের ক্যানসার এমন ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় যারা কখনো ধূমপান করেননি। এটি রোগটির অন্যান্য কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অধূমপায়ীরা পরিবেশগত বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারেন, যা ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রেডন গ্যাসের সংস্পর্শ। এটি একটি প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় গ্যাস, যা মাটি ও শিলা থেকে উৎপন্ন হয়। বাড়িতে প্রবেশ করে এটি বিপজ্জনক মাত্রায় জমা হতে পারে, বিশেষত যেসব বাড়ি সঠিকভাবে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নেই। অনুমান করা হয়, রেডন গ্যাসের কারণে প্রায় ১০ শতাংশ ফুসফুসের ক্যানসার ঘটে, যার মধ্যে অধূমপায়ীরাও অন্তর্ভুক্ত।

অন্যান্য ঝুঁকির কারণ: বায়ু দূষণ, অ্যাসবেস্টস ও জেনেটিক পূর্বাভাস

বায়ু দূষণ অধূমপায়ীদের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি। বায়ুতে থাকা সূক্ষ্ম কণা ও ক্ষতিকর গ্যাস, যা মূলত যানবাহন, কল-কারখানা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত হয়, শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং ক্যানসারের জন্য দায়ী। কিছু গবেষণা দেখায় যে, খুব দূষিত পরিবেশে বসবাসকারী অধূমপায়ীদের ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি ধূমপায়ীদের মতোই।

অন্য একটি বড় কারণ হলো অ্যাসবেস্টস। যদিও অনেক দেশে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত, তবুও এটি অনেক কর্মক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে। অ্যাসবেস্টস ফাইবার শ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।

শেষে, জেনেটিক বা বংশগত কারণও ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। কিছু জেনেটিক মিউটেশন ফুসফুসের কোষকে কার্সিনোজেনিক পদার্থের প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীল করে তোলে। যদিও এই জেনেটিক ফ্যাক্টর তুলনামূলকভাবে বিরল, এটি অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের কারণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিরোধ: সবাই কীভাবে পদক্ষেপ নিতে পারেন

ফুসফুসের ক্যানসার একটি জটিল রোগ যা প্রায়ই দেরিতে শনাক্ত হয়, ফলে এটি চিকিৎসার জন্য আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তবে, ঝুঁকি কমানোর জন্য বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

ধূমপায়ীদের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হলো ধূমপান ছেড়ে দেওয়া। দীর্ঘদিন ধূমপান করার পরেও ধূমপান ছেড়ে দিলে ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে। তবে, ঝুঁকি পুরোপুরি দূর হয় না। ধূমপান ছাড়ার জন্য নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট, আচরণগত থেরাপি এবং কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।

অধূমপায়ীদের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হলো বায়ু দূষণের সংস্পর্শ কমানো এবং বাড়িতে রেডন গ্যাস শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষা করা। কর্মক্ষেত্রে অ্যাসবেস্টসের সংস্পর্শ এড়াতে নিরাপত্তা নির্দেশিকা মেনে চলা এবং ভবন থেকে অ্যাসবেস্টস অপসারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।

আগাম সনাক্তকরণের গুরুত্ব

ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসায় আগাম সনাক্তকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ধূমপায়ীরা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন, অধূমপায়ীরা প্রায়ই এই বিষয়ে মনোযোগ দেন না। ফুসফুসের এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যানের মতো পরীক্ষা অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে পারে, যা বড় সমস্যায় পরিণত হওয়ার আগেই শনাক্ত করা সম্ভব।

যারা দূষিত এলাকায় বাস করেন, অ্যাসবেস্টস বা অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে ছিলেন বা যাদের পরিবারে ফুসফুসের ক্যানসারের ইতিহাস রয়েছে, তাদের নিয়মিত সনাক্তকরণ পরীক্ষা করা উচিত।

ফুসফুসের ক্যানসার একটি জটিল রোগ যা ধূমপায়ী ও অধূমপায়ীদের উভয়কেই প্রভাবিত করে। যদিও ধূমপান প্রধান কারণ, রেডন গ্যাস, বায়ু দূষণ, অ্যাসবেস্টস এবং জেনেটিক কারণও লক্ষ লক্ষ অধূমপায়ীর জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। এই বিষয়টি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, আগাম সনাক্তকরণ এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে সংস্পর্শ কমানোর গুরুত্ব তুলে ধরে। ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে আমরা সবাই মিলে এই ধ্বংসাত্মক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি।

Whatsapp Us