background

মাসিক চক্র বোঝা: একটি ওভারভিউ

post image

মাসিক চক্রটি প্রজনন ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা প্রতি মাসে শরীরকে সম্ভাব্য গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে। এই ঘটনাগুলি মহিলাদের শরীরে স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়াকলাপের অংশ, যা মাসিক রজঃপাত বা জরায়ুর আস্তরণ ঝরে যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়। প্রতিটি মহিলার মাসিক চক্র আলাদা হলেও সাধারণ পর্যায় এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা প্রদান করতে পারে।

স্বাভাবিক মাসিক চক্র ২৪ থেকে ৩৮ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়; গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮ দিন। প্রতিটি মহিলার চক্রের দৈর্ঘ্য কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, তবে বেশিরভাগ মহিলার প্রতিটি মাসে একই ধরণের ওভুলেশন প্রক্রিয়া ঘটে।

মাসিক রজঃপাত

মাসিক বা রজঃপাত হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শরীর গর্ভধারণ না হলে জরায়ুর আস্তরণ ঝরিয়ে ফেলে। এটি একটি নতুন চক্রের সূচনা করে এবং এটি নারীদের প্রজনন চক্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে বিবেচিত হয়। জরায়ুর আস্তরণ থেকে আসা রক্ত এবং টিস্যুগুলি যোনির মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, যা চক্রটিকে পুনর্নবীকরণ করে।

মাসিক চক্রটি হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বেশিরভাগ এই রাসায়নিক বার্তাবাহকগুলি পিটুইটারি গ্রন্থি এবং ডিম্বাশয় থেকে উৎপন্ন হয়, এবং এগুলি শরীরের প্রতিক্রিয়ার একটি ধারাবাহিকতার সূচনা করে। জরায়ুর আস্তরণের বেশিরভাগ পরিবর্তন হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের পরিমাণের পরিবর্তনের কারণে ঘটে। এই পরিবর্তনগুলি ডিম্বাশয়কে একটি ডিম্বাণু ছাড়তে উত্সাহিত করে, যা প্রজননের জন্য প্রস্তুত।

মাসিক চক্র কী?

মাসিক চক্র হলো হরমোন এবং শারীরবৃত্তীয় ঘটনার একটি ধারাবাহিকতা যা প্রতিটি মাসে একজন মহিলার শরীরকে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে। চক্রটি মাসিকের প্রথম দিন শুরু হয়, যা মহিলার মাসিকের প্রথম দিন এবং পরবর্তী মাসিকের প্রথম দিনের মধ্যে শেষ হয়। যদিও প্রতিটি চক্রের দৈর্ঘ্য ভিন্ন হতে পারে, সাধারণ পর্যায়গুলির একই ফাংশন রয়েছে। এই পর্যায়গুলি প্রজনন ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হরমোনের পরিবর্তন দ্বারা শুরু হয়।

যদিও মাসিক চক্রের গড় দৈর্ঘ্য ২৮ দিন, একটি স্বাভাবিক মাসিক চক্র ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে হতে পারে।

চক্রের দৈর্ঘ্য এক মাসিকের প্রথম দিন থেকে পরবর্তী মাসিকের প্রথম দিন পর্যন্ত হিসাব করা হয়। যেহেতু ডিম্বাণু বের হওয়ার আগে সময়ের দৈর্ঘ্য মহিলাদের মধ্যে এবং একই মহিলার বিভিন্ন চক্রের মধ্যে ভিন্ন হতে পারে, তাই ডিম্বাণু বের হওয়ার পর থেকে মাসিকের শুরুর সময় পর্যন্ত সময়ও এক-দুই দিন পার্থক্য হতে পারে।

মাসিক চক্রের চারটি পর্যায়

মাসিক চক্রটি চারটি প্রধান পর্যায় নিয়ে গঠিত যা হরমোনের পরিবর্তনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সম্ভাব্য গর্ভধারণের জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে:

মাসিক পর্যায় (দিন ১-৫): মহিলাদের চক্রটি মাসিকের মাধ্যমে শুরু হয়, যা জরায়ুর আস্তরণ ঝরে যাওয়ার মাধ্যমে হয় যদি গর্ভধারণ না ঘটে। মাসিক সাধারণত তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যার মধ্যে রক্ত এবং টিস্যু শরীর থেকে বেরিয়ে আসে।

ফলিকুলার পর্যায় (দিন ১-১৩): ফলিকুলার পর্যায়টি মাসিক চক্র এবং মাসিক পর্যায়ের সঙ্গে ওভারল্যাপ করে। এই পর্যায়ে ইস্ট্রোজেনের বৃদ্ধি ঘটে, যা জরায়ুর আস্তরণকে পুরু করে তোলে যাতে গর্ভধারণের জন্য ডিম্বাণু প্রস্তুত হতে পারে। একই সাথে, ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) ডিম্বাশয়ের ফলিকলগুলিকে বাড়তে সাহায্য করে। সাধারণত একটিমাত্র ফলিকল সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক হয় এবং ডিম্বাণুটি ডিম্বস্ফোটনকালে ডিম্বাশয় থেকে মুক্তি পায়।

ডিম্বস্ফোটন (দিন ১৪): ডিম্বস্ফোটন হলো একটি পরিপক্ক ডিম্বাণুর ডিম্বাশয় থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া, যা লিউটিনাইজিং হরমোনের বৃদ্ধির ফলে ঘটে। সাধারণত এটি ২৮ দিনের চক্রে ১৪ তম দিনে ঘটে। ডিম্বাণুটি ফ্যালোপিয়ান নালীতে চলে যায় এবং সেখানে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হতে পারে। যদি নিষেক না হয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম্বাণুটি অবক্ষয় হয়।

লুটিয়াল পর্যায় (দিন ১৫-২৮): লুটিয়াল পর্যায়ে ভেঙে যাওয়া ফলিকল একটি "কর্পাস লুটিয়াম" নামক গঠনে পরিণত হয় এবং প্রোজেস্টেরন উৎপন্ন করে। এই হরমোনটি জরায়ুর আস্তরণকে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণুর স্থাপনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। যদি নিষেক না ঘটে, ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কমে যায়, যা জরায়ুর আস্তরণ ভেঙে পড়া এবং পরবর্তী মাসিকের মাধ্যমে ঝরে যাওয়ার কারণ হয়।

মাসিক চক্রের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য এবং মাসিকের সময়কাল

চক্রের দৈর্ঘ্য: মাসিক চক্রের গড় দৈর্ঘ্য ২৮ দিন, তবে ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে চক্রটিকে স্বাভাবিক হিসাবে গণ্য করা হয়। এটি এক মাসিকের শুরুর দিন থেকে পরবর্তী মাসিকের শুরুর দিন পর্যন্ত সময়কে নির্দেশ করে। সংক্ষিপ্ত চক্র (প্রায় ২১ দিন) অথবা দীর্ঘ চক্র (৩৫ দিন পর্যন্ত) থাকলেও এটি স্বাভাবিক বিবেচিত হতে পারে যদি ব্যক্তির হরমোনীয় ভারসাম্য বজায় থাকে।

মাসিকের সময়কাল: বেশিরভাগ মহিলার মাসিক ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়ে রক্তের পরিমাণ সাধারণত দুই থেকে তিন টেবিলচামচ হয়। কিছু মহিলার মাসিকের সময়কাল কম, মাত্র তিন দিন, আবার কিছুদের মাসিক সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

মাসিকের সাথে সম্পর্কিত সাধারণ লক্ষণসমূহ

মাসিকের সময় বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেগুলি হালকা থেকে তীব্র হতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো ক্র্যাম্পিং, কারণ জরায়ু তার আস্তরণ ঝরাতে সংকুচিত হয়। অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে থাকতে পারে:

  • মেজাজ পরিবর্তন: হরমোনের পরিবর্তনের ফলে মেজাজে ওঠানামা বা খিটখিটে মেজাজ হতে পারে।
  • ক্লান্তি: শরীর শক্তি ব্যবহার করে, ফলে ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
  • মাথাব্যথা: হরমোন পরিবর্তন মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের কারণ হতে পারে।
  • খাদ্য বাসনা: হরমোন পরিবর্তনের কারণে কিছু খাবারের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে পারে।
  • ফুলে যাওয়া: অনেকেই পানি ধরে রাখার কারণে ফুলে যাওয়ার অনুভূতি পান।
  • বুকের স্পর্শকাতরতা: হরমোনের ওঠানামা স্তন ফুলে যাওয়া এবং স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি করে।
  • ব্রণ: হরমোন পরিবর্তন ব্রণ বা ব্রণের প্রকোপ বাড়াতে পারে।

বয়সভিত্তিক পরিবর্তনসমূহ

মাসিক চক্র জীবনকালে পরিবর্তিত হয়। বেশিরভাগ মেয়েরা ১২-১৩ বছর বয়সে মাসিক শুরু করে, যদিও কেউ কেউ ৮ বছর বয়সেও শুরু করতে পারে, আবার কেউ কেউ ১৬ বছর বয়সে। মাসিক শুরু হওয়ার পর, চক্রের নিয়মিত হতে কয়েক বছর সময় লাগে। কৈশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক এবং তারপর মেনোপজের কাছাকাছি পৌঁছানোর সময় এই চক্র নিয়মিত হতে পারে।

অনিয়মিত মাসিক চক্রের নির্ণয়

প্রতিটি ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিক মাসিক চক্রের তাল বাদ দেওয়া যায় এমন অনিয়মিত মাসিক হলো যে চক্রটি স্বাভাবিক ছন্দের অনুসরণ করে না। অনিয়মিত মাসিক চক্রের লক্ষণগুলি হলো:

  • মাসিকের ফাঁক ২১ দিনের কম বা ৩৫ দিনের বেশি।
  • ধারাবাহিক তিন মাসের বেশি মাসিক না হওয়া।
  • অতিরিক্ত ভারী বা অতিরিক্ত হালকা প্রবাহ।
  • মাসিক ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হওয়া।
  • মাসিকের সময় তীব্র ক্র্যাম্পিং, বমি বমি ভাব বা বমি।
  • মাসিকের মধ্যে রক্তপাত হওয়া।

এমন লক্ষণগুলি ঘন ঘন হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মাসিক চক্র পর্যবেক্ষণ

আপনার মাসিক চক্র পর্যবেক্ষণ করলে যেকোনো অনিয়মিত বিষয় এবং উর্বরতার সময় বোঝা যায়। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ:

  • চক্রের দৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণ: এটি চক্রের কোনরূপ ধারা বা অনিয়ম লক্ষ্য করতে সাহায্য করে।
  • ডিম্বস্ফোটনের সময় নির্ধারণ: গর্ভধারণের জন্য উর্বর সময় জানতে সহায়ক।
  • মাসিকের লক্ষণগুলির জন্য প্রস্তুতি: বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং পরিকল্পনা করতে সহায়ক।

আপনার মাসিকের প্রথম দিনকে দিন ১ হিসাবে ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত করুন এবং প্রতিটি মাসিকের দিন গুণুন। এটি চক্রের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করতে এবং পরবর্তী মাসিকের সম্ভাব্য সময় অনুমান করতে সাহায্য করে। স্মার্টফোনের অ্যাপও রয়েছে যা আপনাকে আপনার মাসিক চক্র পর্যবেক্ষণে সহায়ক হতে পারে।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

আপনার মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন:

  • ১৬ বছর বয়সে মাসিক না হলে।
  • টানা তিন মাসের বেশি মাসিক না হলে।
  • প্রতি ১-২ ঘণ্টায় প্যাড বা ট্যাম্পন পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা থাকে এমন ভারী রক্তপাত হলে।
  • মাসিকের সময় ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হলে।
  • তীব্র ব্যথা বা ক্র্যাম্পিং, যা দৈনন্দিন জীবনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
  • মাসিকের মধ্যে অনিয়মিত রক্তপাত।
  • অনিরাপদ যৌন সঙ্গমের পরে মাসিক না আসা।

মাসিক চক্র আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য প্রতিফলন করে এবং চক্রের অনিয়ম শরীরে নির্দিষ্ট রোগের লক্ষণ হতে পারে যা চিকিৎসা প্রয়োজন।

উপসংহার

মাসিক চক্র একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা প্রজনন স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক। এটি গর্ভধারণের ট্র্যাকিং, লক্ষণ ব্যবস্থাপনা বা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক। কোনো অনিয়ম বা তীব্র লক্ষণ লক্ষ্য করলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সচেতনতার মাধ্যমে বেশিরভাগ মহিলাই জীবনব্যাপী স্বাস্থ্যকর মাসিক চক্র বজায় রাখতে পারেন।

Whatsapp Us