background

কিডনি সম্পর্কে পরিচিতি

post image

কিডনি দুটি মূল্যবান অঙ্গ, যা শরীরের পেটের গহ্বরে অবস্থিত এবং শিমের আকারের। এগুলি শরীরের রক্ত পরিশোধন, তরল ভারসাম্য এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি কিডনি মূত্রতন্ত্রের অংশ হিসেবে কাজ করে যা শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল ও বর্জ্য অপসারণ করে। এর ফলে শরীরের সঠিক স্বাস্থ্য বজায় থাকে এবং ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ জমে ওঠা রোধ হয়। এই নথিতে কিডনির কার্যক্রম, শারীরিক গঠন, সম্ভাব্য সমস্যা এবং স্বাস্থ্যকর কিডনি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যত্নের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

কিডনির কার্যক্রমের বিবরণ

কিডনি দুটি অত্যন্ত কার্যকর অঙ্গ যা প্রায় প্রতি ঘণ্টায় শরীরের সমস্ত রক্ত পরিশোধন করে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ লিটার তরল প্রক্রিয়াকরণ করে, যা প্রায় একটি বড় বাথটব সমান। এই প্রক্রিয়ার সময়, কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করে এবং এর ফলে শরীর প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে, যেমন সোডিয়াম ও পটাসিয়াম। কিডনি তরল নিয়ন্ত্রণ করে, জল ভারসাম্য বজায় রেখে এবং মূত্রের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণের মাধ্যমে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন প্রায় দুই লিটার মূত্র তৈরি হয়, আর কিডনি প্রায় ১৯৮ লিটার পানি পুনরায় শোষণ করে শরীরের জলীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে।

কিডনির কার্যক্রম ও ঝুঁকি বুঝে নিন

কিডনি বর্জ্য ফিল্টার ছাড়াও আরও অনেক কাজ করে:

  • রক্ত পরিশোধন ও ডিটক্সিফিকেশন: কিডনির টিস্যুগুলি নাইট্রোজেন বর্জ্য (ইউরিয়া), পেশীর কার্যকলাপ থেকে সৃষ্ট ক্রিয়েটিনিন এবং বিভিন্ন মেটাবলিক এসিড পরিশোধন করে।
  • ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য: স্নায়ু ও পেশী কার্যক্রম বজায় রাখতে কিডনি সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের মত ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে।
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: কিডনি রেনিন নামের একটি এনজাইম তৈরি করে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • হরমোন সংশ্লেষণ: কিডনি ক্যালসিট্রিয়োলের মতো হরমোন তৈরি করে, যা ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, এবং এরিথ্রোপয়েটিন যা লোহিত কণিকা তৈরিতে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিডনি সমস্যায় পড়তে পারেন। সেইসাথে, যারা শারীরিক আঘাত বা কিডনির সমস্যা সংক্রান্ত অতীত ইতিহাস রয়েছে, তাদের নিয়মিত কিডনি পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়।

কিডনির শারীরিক গঠন

কিডনির জটিল গঠন রয়েছে যা বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত এবং প্রতিটি অংশ ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে:

  • কিডনি ক্যাপসুল: সংযুক্ত টিস্যুর একটি স্তর যা কিডনিকে সুরক্ষা দেয়।
  • কিডনি কর্টেক্স ও মেডুলা: কিডনির বাইরের স্তরে রয়েছে কর্টেক্স যা ফিল্টারিংয়ের মূল ইউনিট নেফ্রনের অবস্থান, আর ভিতরের মেডুলায় পাইরামিড ও টিউব রয়েছে যা মূত্রকে কিডনির পেলভিসে স্থানান্তরিত করে।
  • নেফ্রন: প্রতি কিডনিতে এক মিলিয়নের বেশি নেফ্রন থাকে। নেফ্রনের গ্লোমেরুলাস নামের ছোট রক্তবাহী নালী এবং কিডনির টিউবগুলি রক্ত ফিল্টার করে।

কিডনির সাধারণ সমস্যাগুলি

কিডনি নানান সমস্যার প্রতি সংবেদনশীল, যেমন:

  • ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD): যেখানে কিডনির কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়।
  • কিডনি স্টোন: খনিজ ও লবণের কঠিন জমা যা প্রায়ই মূত্রের পথ অবরুদ্ধ করে।
  • কিডনি কিস্ট ও পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (PKD): যেখানে কিডনিতে ফ্লুইড ভর্তি থলি সৃষ্টি হয়।

প্রাথমিক লক্ষণ ও পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা

কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • সোয়েলিং: সোডিয়াম জমে গিয়ে শরীর ফুলে যাওয়া।
  • মূত্রের রঙ পরিবর্তন: মূত্র গাঢ়, রক্ত মিশ্রিত বা ফেনায়িত হতে পারে।
  • ক্লান্তি ও দুর্বলতা: বর্জ্য জমে শরীর দুর্বল করে দেয়।

স্বাস্থ্যকর কিডনির জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন

কিডনির সুস্থতার জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • হাইড্রেশন: যথেষ্ট পানি পান করা কিডনি থেকে বর্জ্য দূর করতে সাহায্য করে।
  • সুস্থ খাদ্যাভ্যাস: লবণ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার সীমিত করা।
  • অনুশীলন: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে কিডনিকে সুরক্ষিত রাখে।

স্বাস্থ্যকর কিডনির গুরুত্ব

সুস্থ কিডনি নিশ্চিত করে দৈনন্দিন জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে এবং অনেক জটিলতা থেকে রক্ষা করে।

 

কিডনি স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত যত্ন

কিডনি স্বাস্থ্য বজায় রাখতে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য, নিয়মিত যত্ন এবং পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। নিয়মিত কিডনি পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো প্রাথমিক সমস্যা শনাক্ত করা গেলে সময়মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কিডনি সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো:

  • প্রচুর পানি পান করা: কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে এবং শরীর থেকে বর্জ্য দূর করতে পর্যাপ্ত হাইড্রেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত পানি পান শরীর থেকে টক্সিন এবং অতিরিক্ত খনিজ পদার্থ দূর করতে সহায়ক।

  • স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: কিডনি রক্ষার জন্য লবণ ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়ানো জরুরি, কারণ এই খাবারগুলো শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রোটিন, শাকসবজি ও ফাইবারযুক্ত খাবার গ্রহণ কিডনি স্বাস্থ্যকে উৎসাহিত করে।

  • রক্তচাপ এবং রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। নিয়মিত পরীক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে, ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনি ফাংশন নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।

  • ওজন নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক অনুশীলন: নিয়মিত শারীরিক কার্যক্রম কিডনির কার্যক্রম উন্নত করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক, যা কিডনি স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখে।

  • বিরামবিহীন ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা: প্রায়ই কিছু ব্যথানাশক ওষুধ, যেমন NSAID, অতিরিক্ত সেবন করলে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ সেবন না করাই শ্রেয়।

কিডনি স্বাস্থ্য রক্ষায় পানির ভূমিকা

প্রচুর পানি পান করার ফলে কিডনি থেকে বর্জ্য ও টক্সিন দূর হয়, যা কিডনি স্টোন হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে। এছাড়াও, হাইড্রেশন কিডনি ফাংশনকে সঠিক রাখে এবং শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখে।

কিডনি ব্যথা ও পিঠের ব্যথা পৃথককরণ

কিডনি ব্যথা এবং পিঠের ব্যথা কখনো কখনো একসাথে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তবে কিছু বিশেষ লক্ষণ এই দুটি ব্যথার মধ্যে পার্থক্য করতে সহায়ক:

  • পিঠের ব্যথা: সাধারণত কোমরের নিচে কেন্দ্রীভূত থাকে।
  • কিডনি ব্যথা: সাধারণত পাঁজরের কাছাকাছি, পিঠের মাঝামাঝি বা পাশের দিকে অনুভূত হয় এবং এটি প্রায়শই সংক্রমণ বা বাধার কারণে হয়ে থাকে।

কিডনি ব্যথা প্রায়ই জ্বর, বমি বমি ভাব, বা মূত্রত্যাগে ব্যথার সাথে থাকে, যা সঠিক চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হতে পারে।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন

কিছু বিশেষ লক্ষণ, যেমন শরীর ফোলা, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা, মূত্রের স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিবর্তন, এগুলি কিডনির সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলে বা ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকলে নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিডনি স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার গুরুত্ব

কিডনি শরীরের রক্ত ফিল্টারিং এবং গুরুত্বপূর্ণ হরমোন উৎপাদনের মতো বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে। কিডনি স্বাস্থ্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। নিয়মিত পরীক্ষা, সঠিক জীবনযাপন, এবং লক্ষণের প্রতি মনোযোগ দেওয়া কিডনি স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। সচেতনতা, সঠিক যত্ন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যার সমাধান কিডনিকে দীর্ঘস্থায়ী সুস্থ রাখার মূল চাবিকাঠি।

Whatsapp Us