চিকিৎসাশাস্ত্রে, লুপাসকে সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেমাটোসাস বা সংক্ষেপে SLE বলা হয়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিজের টিস্যুগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এর ফলে সারা শরীরে প্রদাহ, ব্যথা এবং ত্বক, জয়েন্ট, কিডনি, হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসে গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। লুপাসের লক্ষণ, কারণ, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার পদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন যাতে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জীবনের গুণগত মান উন্নত হয়।
লুপাস কী?
লুপাস একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক রোগ, এবং এর প্রকৃতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে স্বাভাবিকভাবে শরীরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করা প্রতিরোধী ব্যবস্থা ভুল করে সুস্থ টিস্যুকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। এই অস্বাভাবিক প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং অঙ্গগুলোর সরাসরি ক্ষতি করতে পারে।
লুপাস একটি সিস্টেমিক রোগ যা শরীরের যে কোনো অঙ্গ বা অংশকে প্রভাবিত করতে পারে। এর লক্ষণগুলো কখনো অক্ষম করে দিতে পারে, আবার কখনো জীবনহানিকর হতে পারে। তবে, বেশিরভাগ মানুষ লুপাসের সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সক্রিয় ও উত্পাদনশীল জীবনযাপন করতে পারেন।
লুপাসের সাধারণ লক্ষণসমূহ
লুপাস রোগের লক্ষণগুলো ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। লক্ষণগুলো মাঝেমধ্যে গুরুতর হতে পারে, আবার কখনো হালকা হতে পারে। এটি সাধারণত ফ্লেয়ার-আপ (অসুখ বৃদ্ধি) এবং রেমিশন (অসুখ হ্রাস) পর্যায়ে বিভক্ত হয়। নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেওয়া হলো:
- গাঁটে ব্যথা এবং মাংসপেশিতে ব্যথা: লুপাসের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। গাঁট ফুলে যাওয়ার কারণে শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথার ফলে নড়াচড়া সীমিত হয়।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি: বিশ্রাম বা ঘুমের পরেও রোগীরা প্রায়ই মারাত্মক ক্লান্ত অনুভব করেন।
- ত্বকের ফুসকুড়ি: বিশেষত নাক এবং গালের ওপর প্রজাপতির আকৃতির লাল ফুসকুড়ি দেখা যায়।
- মাথাব্যথা এবং মাথা ঘোরা: কনফিউশন বা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সমস্যা হতে পারে।
- অকারণে জ্বর: কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই জ্বর হতে পারে।
- চুল পড়া এবং মুখের ভেতরে ক্ষত: সাধারণত লক্ষণগুলোর মধ্যে এটি অন্তর্ভুক্ত।
- শ্বাসকষ্ট বা গভীর শ্বাসে ব্যথা: ফুসফুসের জটিলতার ইঙ্গিত হতে পারে।
- হাত-পা বা মুখের ফোলা: এটি কিডনির সমস্যার লক্ষণ, যা লুপাসের সবচেয়ে গুরুতর অংশগুলোর একটি।
লুপাস মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে, যেমন বিষণ্নতা বা উদ্বেগ, যা শারীরিক লক্ষণগুলো আরও খারাপ করতে পারে।
লুপাসের অন্যান্য ধরণ
SLE ছাড়াও লুপাসের আরও কয়েকটি ধরণ রয়েছে, যেগুলো সাধারণত শরীরের একটি নির্দিষ্ট অংশকে প্রভাবিত করে:
- কিউটেনিয়াস লুপাস ইরাইথেমাটোসাস: লুপাসের একটি হালকা রূপ, যেখানে শুধুমাত্র ত্বকে ফুসকুড়ি বা লেশনের মতো লক্ষণ দেখা যায়।
- ড্রাগ-ইনডিউসড লুপাস: কিছু ওষুধের কারণে সৃষ্ট লুপাস। ওষুধ বন্ধ করার পর এই লক্ষণগুলো সাধারণত সেরে যায়।
- নিওনেটাল লুপাস: এটি একটি বিরল ঘটনা, যেখানে মায়ের অ্যান্টিবডি শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। শিশুরা সাময়িক ত্বকের ফুসকুড়ি, যকৃতের সমস্যা বা হৃদযন্ত্রে জটিলতা নিয়ে জন্মাতে পারে।
লুপাসের কারণ
লুপাসের সঠিক কারণ অজানা, তবে কিছু কারণকে এর বিকাশ এবং বৃদ্ধি করার জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়:
- জেনেটিক পূর্বপ্রবণতা: পারিবারিক ইতিহাসে লুপাস বা অন্য কোনো অটোইমিউন রোগ থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
- হরমোনজনিত কারণ: বিশেষত ইস্ট্রোজেনকে লুপাসের একটি সম্ভাব্য কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
- পরিবেশগত কারণ: অতিরিক্ত রোদ, দূষণ এবং সংক্রমণের মতো পরিবেশগত কারণ লুপাসের কারণ হতে পারে।
- জীবনযাপনের ধরন: ধূমপান এবং মানসিক চাপ লুপাসের লক্ষণগুলো আরও খারাপ করতে পারে।
লুপাস কারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
যদিও যে কেউ লুপাসে আক্রান্ত হতে পারে, কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এই রোগে বেশি ঝুঁকিতে থাকে:
- মহিলারা: লুপাসে আক্রান্তদের প্রায় ৯০% নারী, বিশেষত ১৫-৪৪ বছর বয়সী।
- নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী: আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানিক, এশীয় এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঝুঁকি বেশি।
- পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের সদস্য, বিশেষত পিতা-মাতা বা ভাই-বোনদের মধ্যে কারও লুপাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
লুপাসের চিকিৎসা পদ্ধতি
লুপাসের কোনো নিরাময় নেই, তবে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চিকিৎসার লক্ষ্য হলো প্রদাহ কমানো, অঙ্গ রক্ষা করা এবং ফ্লেয়ার-আপ কমানো।
সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতিসমূহ:
- হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (Plaquenil): প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs): হালকা ব্যথা এবং প্রদাহের জন্য।
- কোরটিকোস্টেরয়েডস: তীব্র প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত।
- ইমিউনোসাপ্রেসেন্টস: শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দমন করতে ব্যবহৃত।
- বায়োলজিক থেরাপিস: নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি, যা নির্দিষ্ট প্রতিরোধী অংশকে লক্ষ্য করে।
উপসংহার
লুপাস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, তবে সঠিক যত্ন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। চিকিৎসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে লুপাস আক্রান্ত ব্যক্তিরা সক্রিয় ও উৎপাদনশীল জীবনযাপন করতে পারেন।